শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

আম্মু, দেখি তোমার পায়ের নীচে, ওখানে নাকি আমার বেহেশত??


‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত’-প্রথম শুনেছিলাম শাহওয়ালীউল্লাহ স্কুলে ইসলামিয়াত ক্লাসে। খুব সম্ভব থ্রী বা ফোরে পড়ি তখন। বাসায় এসে আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আম্মু, তোমার পায়ের নীচে বলে আমাদের বেহেশত? কোথায় দেখি তোমার পায়ের নীচে? আম্মু খুব হেসেছিলো। আম্মু যখন প্রাণখুলে হাসে তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগে আম্মুকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আম্মু হাসতে হাসতে বলেছিলো ‘আমার সাথে দুষ্টামী করস? সত্যি সত্যি আমার পায়ের নীচেই কিন্তু তোদের বেহেশত’!
কথাটা এতবার শুনেছি যে, মায়ের পায়ের নীচে আসলেই যে সন্তানের বেহেশত, এর অর্থই বা কী, কেনই বা এটা বলা হয়েছে- তেমন আলাদাভাবে কখনো চিন্তা করিনি। উলটা জীবনের একটা সময়ে আম্মু ছিলো আমার সবচে’ বড় দুশমন। সবভাইবোনদের মধ্যে খুব সম্ভব আমি হচ্ছি সবচে’ বেশী স্বাধীনচেতা। আমাকে নিয়ে তাই আব্বুম্মুর ঝামেলার কোনো কমতি ছিলোনা। আম্মু প্রথম শত্রু হয়ে উঠেছিলো জোড় করে মাদ্রাসায় পড়তেই হবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর। বড়ভাইয়া, আমি, আমাদের সব ভাইবোনদেরকে আম্মু মাদ্রাসায় পড়াবেই! আরে কী মুশকিল! এটা কী ডিক্টেটরশীপের জমানা নাকি?? তুমি নিজে পড়েছো স্কুলে-কলেজে-ইডেনে-ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, আর এখন আমাদেরকে পড়াবা মাদ্রাসায়!!! এটা কী ধরনের কথা?? তোমার কথা মত দাখিল পর্যন্ত তো পড়ছি, এইবার আমাকে আমার মত পড়তে দাও। নাহ, কে শুনে কার কথা!


বড়ভাইয়াও আমার মত কিছুটা উলটাপালটা করলেও ও কেমন যেন একটু বাবা-মা অনুগত আছে। ওকে যখন আম্মু আলিমের পর সোজা দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ পড়তে পাঠালো (ওকেও ইসলামিক থিঙ্ক-ট্যাংক বানাতে চেয়েছিলো আম্মু!!)ওখানে ওকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেনো ও এই সাবজেক্ট পড়তে গিয়েছে, ওর সোজা সিম্পল উত্তর ছিলো ‘আম্মু চায় আমি এটা পড়ি’! ব্যাস, হয়ে গেলো তো আমার কম্ম সাড়া? ভেবেছিলাম বড়ভাইয়া বিদ্রোহ করলে আমার বিদ্রোহ করাটা একটু সোজা হবে। কিন্তু কীসের মধ্যে কী।

আচ্ছা, আম্মুর কথামত আলিমও পড়লাম, যদিও যুদ্ধে হার মানলেও ঠিকই জিদ করে সাইন্স নিলাম। আলিম শেষ, এইবার তো আমাকে জার্নালিজম পড়তে দাও আমার মা। কিন্তু হায়! সে যাকগে। ঐ যুদ্ধ যুদ্ধ সময়েই আম্মু ছিলো আমার চরম শত্রু। কী মুশকিল, আমার কিছুই আম্মু বুঝেনা। বলি একটা বুঝে আরেকটা। আমার চাওয়া’র পুরাপুরি উল্টাদিকে আম্মুর চাওয়া। শুধু মাদ্রাসায় পড়ানো নিয়ে না, সবকিছু নিয়েই। তারউপর তো আছে জেনারেশন গ্যাপ। শেষে রেগেমেগে ঘর থেকেই বের হয়ে গেলাম। ধুর। ঘরে যখন এত অশান্তি থাকুক আম্মু আম্মুর মত। অবশ্য ঘর থেকে বের হয়েও লাভ হলোনা, আম্মুর পছন্দের সাবজেক্টেই ভর্তি হতে হলো অনার্সে, কোরানিক সাইন্সে। শুধু বড়ভাইয়া, আমি আর আমার ভাইবোন?? আম্মু পারলে পরিচিত যতজনের বাচ্চাকাচ্চা আছে সবাইকে ধরে ধরে মাদ্রাসায় পড়ায় আর ইসলামিক থিঙ্ক ট্যাংক বানায় আর কি!!
সেই যে আলিমের পর ঘর থেকে বের হলাম, এরপর আর ঘরে ফেরা হয়নি। আম্মুর সাথে রিকনসিলিয়েশানেরও আর কোনো সুযোগ হয়নি। তারপর খেয়াল করে দেখতাম, আসলে সমস্যা শুধু আম্মু আর আমার মধ্যেই না, আমার বয়সী প্রায় মেয়েদেরই এক সমস্যা, তাদের মা’রা তাদেরকে বুঝেনা! কী আজব! মা’গুলো সব কেমন যেন শত্রু হয়ে যায় একটা সময়ে এসে, কী মুশকিল। উলটা দেখা যেতো বান্ধবীর মা ধরে বসিয়ে বান্ধবীর নামে অভিযোগ, তোমার মত ভাল মেয়ের সাথে মিশেও দেখো ও কেমন বজ্জাত হচ্ছে! আর আমি মনে মনে জিহবা কাঁমড়াতাম, হা খোদা, আন্টি যদি ঘুনাক্ষরেও জানতেন আমি নিজেই আমার মা’র সাথে কেমন যুদ্ধে আছি!!

আব্বুম্মুকে প্রথম একটু একটু উপলব্ধি করি বেশী বেশী ক্রেডিট নিয়ে মাত্র সাড়ে তিনবছরেই অনার্স শেষ করে বিদেশে চলে গিয়ে। খুব বেশী স্বাধীনচেতা হওয়ায় ছোট্ট জীবনেই এত বেশী প্রবলেম ক্রিয়েট করে ফেলেছিলাম, তখন কেবল মনে হতো, ধুর এই দেশেই থাকবোনা। বিদেশ মানেই ছিলো যেনো বাঁধনহারা স্বাধীনতা, নিজের মত করে চিন্তা করার, নিজের মত করে স্টাডি করার, নিজের মত করে থাকার সুযোগ। কিন্তু যখন বিদেশের ক্যাম্পাসে আমাকে রেখে আব্বু চলে যাচ্ছিলেন, জীবনে তখন প্রথম দেখলাম আব্বু আমার জন্য কাঁদছেন!! আমাকে কান্না না দেখানোর জন্য তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরলেন গাড়ীর দিকে। পিছন থেকে দেখলাম আব্বু পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছছেন। কেমন যে লেগেছিলো, বুকটা মনে হচ্ছিলো কেউ মুচড়ে দিয়েছে। হু হু করে কেঁদে ফেলেছিলাম ওখানে দাঁড়িয়েই। নিজেকে কেমন এতিম মনে হচ্ছিলো। এই বিদেশের মাটিতে, কেউ তো আমার ভাষাতেও কথা বলেনা। এখন তো অন্ততঃ যুদ্ধ করার জন্যও কেউ নাই!! ক্যাম্পাসের অনেকেই অবাক হয়ে দেখেছিলো বিদেশী একটা মেয়ে নিজের লাগেজের উপর বসে বসে কাঁদছে!!

আব্বুকে তো ফিল করা শুরু হলো, কিন্তু আম্মু? দেখা যেতো বুরোক্র্যাটিক জটিলতায় মান্থলি স্কলারশিপের টাকাটা পেতে দেরী হচ্ছে, পুরা হাত খালি, দু’দিন ধরে না খেয়ে আছি, অনেক আশা নিয়ে বাসায় ফোন করেছি আব্বুম্মুর গলা শুনবো বলে, আব্বু ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করেন ‘বুড়ি, কী খাইছো?’ বানায়ে বানায়ে বলে দিয়েছি ‘আজকে খুব ভালো খেয়েছি আব্বু, ডাইনিং এ এটা দিয়েছে, ওটা দিয়েছে’ আসলেতো পেটে কিছুই নেই, শুধু পানি খেয়ে বেঁচে আছি। আব্বুকে বললাম আম্মুকে দেন, কথা বলি। অনেক আশা নিয়ে আছি আম্মু ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করবে কেমন আছস? উলটা আম্মু প্রথমেই কী জিজ্ঞেস করে জানেন?? ‘কোরান-হাদীস পড়স তো ঠিকমত?’ সেবার ফোন রেখে হু হু করে কেঁদেছিলাম। কেমন যেন মনে হয়েছিলো ধুর, আমি মনে হয় আম্মুর আসল বাচ্চা না, আমাকে মনে হয় হসপিটাল থেকে পালক এনেছিলো! (হিহিহি, এখন মনে পড়লে কী হাসি পায়!)

আম্মুর উপর রাগ নিয়ে প্রথমবার ভাবতে বসেছিলাম বড়ভাইয়ার একটা মেইল পেয়ে। বড়ভাইয়া খুব ভাল করেই জানে কী ভীষণ রাগ আমার আম্মুর উপর। কীসের জন্য যেনো বড়ভাইয়া সেবার বিশাল একটা মেইল করলো। একটা জায়গায় লিখেছিলো আমাদের নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখা দরকার আম্মু কীভাবে প্রতিদিন, দিনের পর দিন আমাদের জন্য খেঁটে যাচ্ছে। স্পষ্ট মনে আছে মেইলটা পড়ে আমার কিউবিকল রুমটার পাশের টেরেসে বসেছিলাম অনেক্ষন। এম্নিতেই দেশ থেকে দূরে, যত শত্রুই হোক, আব্বুম্মু থেকে দূরে, ভাই-বোনদের থেকে দূরে, বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরে, নিজের পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে, তারমধ্যে বড়ভাইয়ার এই মেইল; জীবনে প্রথম আম্মুর উপর কোনো রাগ ছাড়া আম্মুকে নিয়ে ভাবছিলাম। এবং ভেবে দেখেছিলাম আসলে বড়ভাইয়া যা বলেছে তা মিথ্যা না।

এখনও আম্মু বাসার সবার কাপড় ধোঁয়, বুয়া যতই ধুঁয়ে যাক, আম্মুর পছন্দ হয়না। আম্মুকে হাত লাগাতেই হবে। এখনো আম্মুইতো বলতে গেলে রান্নাবান্না করে। বুয়া টুকটাক শুধু কেঁটেকুঁটে দেয়। আমি নিজে কোনোদিন কিচেনে ঢুকিনি। কেনো ঢুকিনি? কারণ আম্মু কোনোদিন ঢুকতে বলেনি! কী অদ্ভুত, এটা কী কখনো খেয়াল করেছি যে আম্মু এইসব নিয়ে আমার উপর কোনোদিন প্রেশার দেয়নি! হলে যাওয়ার আগ পর্যন্ততো চা-ও বানিয়ে খেতে পারতাম না! এই যে পরীক্ষার সময় আম্মু ভাত মাখায়ে প্লেট নিয়ে নিয়ে পিছন পিছন ঘুর ঘুর করতো ‘একটু খেয়ে যা! একটু খেয়ে যা!’ আর পড়ার চাপে, টেনশানে চিৎকার করতাম ‘বললাম না খাবোনা! বিরক্ত করবানা বলছি, খাবোনা ব্যাস খাবোনা’, তারপরও আম্মু নিজের হাতে ভাতের নলা মুখের কাছে এনে বলতো ‘এইরকম জিদ ভালো না, আচ্ছা আমি খাওয়ায়ে দেই, একটা ন’লা খা! এই একটা নলা খেয়ে যা’! আশ্চর্য্য, এইসব কেনো আমার চোখে পড়েনাই এতদিন?? নিজে কোনোদিন বাজারে যাইনি, বাসার কাজে শুধুমাত্র ঘর-দোর গোছানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেছি বলেও মনে পড়েনা; কী অদ্ভুত! আম্মু একলা একলাই তো এইসব করে এসেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর!! এমনকি ক্লাস নাইন-টেনে উঠে পর্যন্ত আম্মু আমাদেরকে ভাই-বোনদেরকে ভাত মাখায়ে দিতো বড় একটা বলে। আমরা বল থেকে প্লেটে নিয়ে খেতাম। কারণ আম্মু শাক-সব্জি দিয়ে কেমন করে যেনো মাখাতো আমরা বুঝতাম না ভাতের সাথে শাক আছে! বুঝলেই তো খেতে চাইবোনা!!

বুরোক্র্যাটিক জটিলতায় স্কলারশিপ আর কোর্স ইউনিট নিয়ে গন্ডগোল হওয়ায় শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে বিদেশে পড়ালেখা বাদ দিয়ে যখন আবার দেশে এসে একই ইউনিতে একই সাবজেক্টে মাষ্টার্সে ভর্তি হলাম, একদিন তাফসীর ক্লাসে স্যার প্রসংগক্রমে সূরা ইসরার ২৪ নং আয়াত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় মজার একটা গল্প বললেন। গল্পটা হুবুহু মনে নেই, তবে ঈশপের গল্প টাইপের। মূল যা মনে আছে তা হলো- এক লোক গিয়ে জ্ঞানীকে বললো ‘জ্ঞানী, এই যে মেয়েদের শরীর থেকে বাচ্চা হওয়াটা এত কষ্ট, আল্লাহ কেনো এত কষ্টকর পদ্ধতি বানালেন? এটা তো মেয়েদের উপর না-ইনসাফী। আল্লাহ চাইলেই তো বাচ্চারা ফলের মত গাছে গাছে ধরতে পারতো। যার বাচ্চা লাগবে সে গাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে যেতো’। জ্ঞানী তখন ঐ লোককে বললেন ‘আমার সাথে চলো’। চলতে চলতে দুইজন একটা নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নদীর পানি হঠাৎ করে বেড়ে গিয়ে প্রচন্ড বন্যা হচ্ছিলো। বন্যার পানিতে একটা বাচ্চাও ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু বাচ্চার মা নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত। লোকটা যখন রেগে গিয়ে বাচ্চার মা’কে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখন জ্ঞানী বললেন ‘ঐ মহিলাকে বলে কী লাভ? বাচ্চাটাতো গাছে ধরেছে। এক বাচ্চা চলে গেলে সমস্যা কী, আরেকটা বাচ্চা গাছ থেকে নিয়ে আসবে’! তখন লোকটা বুঝলো আল্লাহ আসলে কেনো এই পদ্ধতি বানিয়েছেন।
এর কিছুদিন পরেই যেদিন আমার বিয়ে হলো, আব্বুম্মুকে সেদিন আসলে কেমন যেন সবচেয়ে বেশী ফিল করলাম। আম্মু যদিও আমার বিয়েতে পর্যন্ত তার অর্গানাইজেশানের কাজ নিয়ে ব্যস্ত (!!!), কিন্তু আমাকে বিদায় দেয়ার মুহূর্তে আম্মু যখন জড়িয়ে ধরলো, বাপরে আমার কান্না দেখে কে! নিজেও জানিনা কখন বলা শুরু করেছিলাম ‘আম্মু আমি বিয়ে করবোনা। চলো বাসায় চলে যাই’! (হিহিহিহিহিহি!) বিয়ের পর আস্তে আস্তে যত সংসার জীবনের সাথে পরিচিত হয়েছি (এখনো হচ্ছি!!) ততই এখন বুঝি আম্মু আসলে কীভাবে বছরের পর বছর, দিনের পর দিন আমাদের ভাইবোনদেরকে পেলেছে, বড় করেছে, আত্মীয়-স্বজনের হক্ব আদায় করেছে, নিজের অর্গানাইজেশান সামলেছে, রান্না-বান্না ঘরদোর সামলানো, বাপরে! কেউ যদি এখন জিজ্ঞেস করে ‘সুপারমম’ কাকে বলে? আমি নিঃসন্দেহে বলবো আমার মা’কে বলে।

সে যা হোক, আগে যখন রাগারাগি করতাম আম্মু দুইটা কথা বলতো, এক “নিজের সংসার হোক, তারপর বুঝবি!” দুই “তোর নিজের যখন বাচ্চা হবে তখন বুঝবি”! অক্ষরে অক্ষরে কথাদু’টো যে আসলে কতটা সত্য এটা মনে হয় শুধু মেয়েরাই জানে। নিজে বিয়ের পর, নিজের সংসার হওয়ার পরই মনে হয় আম্মুকে আমি সত্যিকারভাবে ফীল করা শুরু করি। মানুষ আসলে স্বভাবগতভাবেই এমন যে তাকে নিজে সাপে না কামড়ালে সে বুঝেনা সাপের কামড় কী জিনিষ! (ইয়ে, আমি কিন্তু বলছিনা যে বিয়ে করা মানে সাপড় কামড় খাওয়া!! এটা জাষ্ট উদাহরণ)।

কিন্তু আব্বুম্মুকে যে আসলে বুঝার এখনো কত বাকী, তার পরবর্তী ধাপে গিয়ে যখন প্রথম বাবুটা মিসক্যারেজ হয়ে গেলো, কেমন অদ্ভুত খালি খালি লাগছিলো বুকটা, আম্মু ফোনের ওপাশে প্রথমেই বলেছিলো ‘তোর নানী বলে দশটা বাচ্চা হওয়ার যে কষ্ট, একটা বাচ্চা চলে যাওয়ার কষ্ট তারচে’ বেশী’, আমি হাজার হাজার মাইল দূরে ফোনের এপাশ থেকে বুঝেছিলাম আমার কষ্টে আম্মু কী ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। হসপিটালের বেডে শুয়েই শুয়েই বুঝেছিলাম আসলে বয়সের সাথে সাথে আব্বুম্মু অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। আব্বুম্মু নিজের চারপাশে আগে যে দূর্ভেদ্য একটা দেয়াল তুলে রেখেছিলো সে দেয়াল এখন অনেক নরম হয়ে গেছে। কারণে-অকারণে এখন সে দেয়াল ভেদ করে মায়া-মমতা, ভালবাসা প্রকাশ পেয়ে যায়। আব্বু তাই এখন মেয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় চোখের পানি লুকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আম্মু তাই এখন ফোনের ওপাশে উদ্বিগ্ন গলায় বলে ‘তোর গলা এমন শোনায় কেনো? শরীর খারাপ?’ হায়রে বাবা-মা!

ইদানীং বেশকিছুদিন ধরে ভাবছি, আসলে কেনো বাবা-মা’র সাথে বিশেষ করে মা’দের সাথে একটা সময়ে আমাদের, অর্থাৎ সন্তানদের এত দ্বন্দ লেগে যায়? কেনো তখন সন্তান মা’কে বুঝেনা? মা সন্তানকে বুঝেনা? আগে তো এমন হতো না। কই আমাদের আব্বুম্মুদের সময়ে তো ‘জেনারেশ গ্যাপ’ এই শব্দটাও ছিলোনা! যদিও উত্তর দেয়ার মত বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার এখনো নেই, কিন্তু ভেবে ভেবে দেখলাম, অনেকগুলো কারণের মধ্যে কয়েকটা কারণ খুব সিগনিফিকেন্ট।

দিন দিন আমাদের সমাজে পরিবারগুলো ছোট হয়ে আসছে। সেই সাথে বাড়ছে কমপ্লিকেশান্স। আগে বাবা-মা’রা সন্তানের সাথে বন্ধুবৎসল না হলেও চলতো, কারণ সন্তানের বন্ধু হওয়ার জন্য দাদা-দাদী, নানা-নানী আছে। বা এমনকি অনেক পরিবারে তো সমবয়সী খালা-চাচাও মিলতো। এসব বেশীদিন আগের কথা না। কিন্তু এখন পরিবার যত নিউক্লিয়ার সাইজের হচ্ছে, সন্তানের গন্ডীও তত ছোট হচ্ছে, সীমিত হচ্ছে, তার অনেক চাহিদা আগে যত সহজে মিটে যেতো, এখন মিটছেনা। এজন্যেই বলছি, আগে বাবা-মা বন্ধু না হলেও চলতো, কিন্তু এখন চলেনা। এখন যদি বাবা-মা’রা সন্তানের সাথে একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে সন্তান বাইরের দিকে ঝুঁকে, বন্ধু-বান্ধবীদের দিকে ঝুঁকে, এখানে ওখানে কোথায় গিয়ে যে সে তার চাহিদা মেটায়, বাবা-মা’রা যদি জানতেন, শিউর হার্ট এটাক হয়ে যেতো ওনাদের।

সেই সাথে, আমাদের মা’রা আমাদেরকে অর্থাৎ সন্তানদেরকে তাদের কষ্ট দেখান না। হ্যা, মুখে মুখে বলেন ‘তোদের জন্য জীবন শেষ করে দিলাম!’ ‘তোদেরকে এত কষ্ট করে পেটে ধরেছিলাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু বাস্তবে মা’রা আসলে কতটুকু কষ্ট শেয়ার করেন তার সন্তানের সাথে? শরীরের যত কষ্টই হোক, মা কিন্তু দিনের পর দিন সংসারের নিত্যদিনের কাজগুলো করে যান। এবং সন্তান একসময় দেখতে দেখতে এতটাই অভ্যস্থ হয়ে পড়ে যে মা’র কাজগুলো তার কাছে অনেকটা গ্রান্টেড হয়ে যায়। যেনো সংসারে এটাই মা’র ভূমিকা। সে বরং তখন উলটা ডিমান্ডিং হয়ে উঠে। মা যে নিজে একটা মানুষ, তারও যে চাওয়া-পাওয়া আছে এবং তারও যে একান্ত জীবন আছে এইসব তখন আর সন্তানের মাথায় ঘুনাক্ষরেও আসেনা।

আমার এক বান্ধবীর ঘটনা বলি, যে কিনা তার মা’র সাথে আমার চে’ও মারাত্মক যুদ্ধ করছিলো। একদিন হঠাৎ দেখি সে খুব আনমনা, খুব চুপচাপ। জিজ্ঞেস করলাম ‘কীরে, কী হইছে?’ অনেক্ষণ চুপ থেকে বললো ‘জানস কী হইছে? কালকে খাটের তলা পরিষ্কার করতে গিয়ে মা’র অনেক আগের একটা ডায়রী পাইছি। মা’র বিয়ের সময়কালের। তুই জানস মা কবিতা লিখতো সে সময়??! বিশ্বাস হয়?? এই সেই কবিতা না দোস্ত, একদম পুরা সাহিত্যিক কবিতা! কঠঠিন ভাষা। তারমধ্যে আবার একটা ছবি পাইছি, মা যে কী সুন্দর ছিলো! অবিশ্বাস্য, আমি মিলাইতেই পারতেছিনা আমার মা-ই এই ডায়রীর মেয়ে!’
বান্ধবীর সে শকিং ফেইসটা দেখার মত ছিলো। মজার কথা হলো এরপর থেকে ও ওর মা’কে বিরক্ত করার জন্য ডাকতো কবিতা-মা! ওর মা বিরক্ত হলেও আমরা উনার চেহারার এক্সপ্রেশানেই বুঝতাম আন্টী মজা পান ডাকটাতে। এবং ঐ ঘটনার পর ওদের মা-মেয়ের রিলেশান অনেক সহজ হয়ে যায়। সামান্য কিছু তথ্য, মা কবিতা লিখতেন, মা ডায়রী লিখতেন, মা সুন্দর ছিলেন এই কয়েকটা তথ্যতেই কীভাবে একটা সম্পর্ক বদলে যায় দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আমাদের মা’রা স্যাক্রিফাইস করতে করতে এতটাই স্যাক্রিফাইস করেন যে, তার নিজের সবকিছু হারিয়ে যায়। আমার কেনো যেনো মনে হয় এত বেশী আত্মপরিচয় হারানোটা ঠিক না। এমনকি সন্তানও চায় তার মা’র একটা নিজস্ব সত্ত্বা থাকুক, মা’কে নিয়ে খুশী হওয়ার মত, বলার মত কিছু থাকুক। সন্তানের বুঝার দরকার আছে তার মা জন্ম থেকেই এমন মা বনে আসেননি পৃথিবীতে। তিনি একজন মেয়ে ছিলেন। একজন মানুষ ছিলেন। যার শখ-আহ্লাদ ছিলো। অনেক কিছু করার ছিল, অনেককিছু বলার ছিলো।

আরো কিছু পরিবারের সাথে মিশে খেয়াল করেছি যে পরিবারে বাবা-মা তাদের বিয়ের আগের স্মৃতি, ঘটনা, নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা তাদের সন্তানদের সাথে শেয়ার করেন, সেসব পরিবারে সন্তানরা বাবা-মা’র আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। বাবা-মা’র সাথে অনেক কিছু অনেক সহজে শেয়ার করে। এমনকি আড্ডায় মা’র উপস্থিতিও এদের কাছে অনেক স্বাভাবিক। অথচ অন্যান্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়ে তার বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় মা এসে উপস্থিত হলে মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে ‘আম্মু যাওতো এখান থেকে!’

অনেক বন্ধু-বান্ধবীর বাসায় দেখেছি ওদের রুম পুরা আলাদা। সেই রুমে বাসার কারো, এমনকি মা’রো প্রবেশাধিকার নেই! বিশেষ করে এমন দেখেছি ছেলেদের ক্ষেত্রে। বাসায় গিয়ে ভীষণ রাগারাগি, কারণ কী? সিম্পল, সে বাসায় না থাকা অবস্থায় আন্টি গিয়ে তার রুম পরিষ্কার করেছে, গুছিয়েছে! ছেলে রাগ করে বলছে ‘তোমাকে না বলছি আমি না থাকলে আমার রুমে কেউ ঢুকবেনা? না, তুমিও ঢুকবানা। আমার রুমে তোমার কী দরকার? আমি যেমনে ইচ্ছা তেমনে থাকবো’! মা সবসময়ই এমন রাগারাগি সহ্য করেন, তারপরও গুছান। তারপরও ছেলের রুম পরিষ্কার করেন! একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই মা নিজেকে বাসার কাজের বুয়ার অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন। বুয়ারা তো তাও টাকার জন্য কাজ করে। এই মা নিজের থেকেই কোনো বিনিময় ছাড়াই ছেলের রুম গোছান, পরিষ্কার করেন, আবার রাগারাগিও সহ্য করেন।

সেইসাথে ইদানিং খুব ফীল করছি, বাবা-মা’দের খুব খুব দরকার তাদের সন্তানের সাথে সেই সন্তান হওয়ার কষ্ট, অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। এখানে একজন ভাবী দ্বিতীয়বারের মত প্রেগন্যান্ট। আমার নিজেরই শরীর ভালোনা, তারপরও যখন ভাবীর বাসায় গেলাম, উনার প্রথম পিচ্চিটা দেখি তার মা’র পেট জড়িয়ে ধরে একটু পর পর বলে ‘বেবী, মা’কে বেশী কষ্ট দেয়না’! আমি তো হাঁ! ঘটনা কী? ভাবী বললেন পিচ্চি যখন থেকে দেখেছে মা একটু পর পর বমি করেন, একটুতেই টায়ার্ড হয়ে শুয়ে পড়েন, পিচ্চি খুব কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলো। ভাবী তখন ওকে পাশে বসিয়ে আস্তে আস্তে বুঝিয়েছেন যে যেহেতু পেটের ভিতর আরেকটু বাবু বড় হচ্ছে তাই উনার এত কষ্ট হচ্ছে। সেই থেকে উনি বমি করলেই পিচ্চি দৌঁড়ে এসে উনার পেট ধরে বলে ‘বেবী, নড়াচড়া করোনা! মা বমি করছে’! ছেলেরা বুঝবেন না, কিন্তু যেসব মেয়েদের বাচ্চা হয়েছে বা হবে তারা জানে, প্রেগন্যান্সির সময় সম্ভাব্য মা’র সবচে বেশী দরকার অন্যদের আন্তরিক ব্যবহার, যত্ন, একটু মানসিক কমফোর্ট। কারণ শারীরিক কষ্ট তো কেউ দূর করতে পারেনা, কিন্তু একটু কথা দিয়ে যে কতটুকু সাপোর্ট দেয়া যায় তা অন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে এই ভাবী তার নিজের সন্তান থেকেই যে আন্তরিকতাটুকু পাচ্ছেন, এক কথায় অতুলনীয়। সেই সাথে পিচ্চি নিজেও আরেকটা বাবু আসার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিচ্ছে সাবকনশান্স মাইন্ডেই। আরেকটু বড় হলে সে বুঝবে সে নিজেও তার মা’কে এভাবে এইরকম কষ্ট দিয়েই এসেছে। আমি একজন ইউনিভার্সিটির ম্যাডামকে জানি যার বড়ছেলে আমার সামনে একবার তার ছোটভাইকে ধমক দিয়ে বললো ‘তুমি আম্মার সাথে রাগারাগি করছো, তুমি জানো তুমি হওয়ার সময় আম্মা কত কষ্ট পেয়েছে?’ আমি সেই কথা শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। বাপরে!

অনেকেই মনে করে থিউরী শুনে শুনে, উপদেশ শুনে শুনেই বুঝি বাচ্চারা বাবা-মা’দেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে। যারা এই সময়ে, এই যুগের প্রেক্ষাপটে এমনটা মনে করেন আমার কাছে তাদেরকে ভুল মনে হয়। হ্যা, কিছু সন্তানই আছে যারা বেসিক্যালি বাবা-মা’কে শ্রদ্ধা করে কোনো ইনফ্লুয়েন্স ছাড়াই এবং বিশেষ করে আগের কালে এটাই স্বাভাবিক ছিলো। কারণ আগের কালের সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছু ভিন্ন ছিলো। আমাদের আব্বুম্মুদের সময়ে টীচার মানে ছিলো বাবা-মা’র মত। আর এখন? এখন টীচার মানে সবচে বড় দূর্ণীতিবাজ! আব্বুম্মুদের সময়ে স্কুল মানে ছিলো সত্যিকার অর্থে খেলে-ধুলে, পড়ালেখা করে বড় হওয়ার যায়গা, আর এখন? এখন স্কুল মানে একধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেখানে বাচ্চারা উলটা খারাপ হয়ে যাওয়া শিখে। আবুম্মুদের সময়ে কোনো বাচ্চা উলটাপালটা কিছু করলে পাশের বাড়ীর মুরুব্বীরা পর্যন্ত শাসন করেছেন। আর এখন? এখনতো মুরুব্বীদেরকেই শাসন করা লাগে সমাজের পঁচে যাওয়া ব্যবস্থার কারণে। তাই এতদিন কীভাবে সন্তান বড় হয়েছে, নিজেরাই অটোমেটিক ভাল হয়ে উঠেছে সে হিসাব করাটা বোকামী হবে। এখন আমার মনে হয় বাবা-মা’কে বুঝাটা সন্তানের জন্য, এবং সন্তানকে বুঝাটা বাবা-মা’র জন্য খুবই জরুরী। এবং এই বুঝার ব্যপারটা একমাত্র বাবা-মাই ফ্যাসিলিয়েট করতে পারেন সন্তানের ছোটবেলা থেকে।

আর যাই করুক, আমার আব্বুম্মু এই ফ্যাসিলিয়েটটুকু করেননি, এবং করেননি বলেই এখনো আম্মুকে বুঝা, আব্বুকে বুঝাটা বিশেষ করে আমার জন্য অন-গোয়িং প্রসেসে থেকে গেছে। এখনতো এক একটা দিন যায় আর আব্বুম্মু থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আব্বুম্মুকে নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখি। আর খালি আফসোস হয়, যদি আরো আগে বুঝতাম!


[ লিখেছেনঃ Farjana Mahbuba
ব্যক্তিগত ব্লগঃ http://jajaborrr.blogspot.com ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন